World Health Organization বা WHO এর সংজ্ঞা অনুযায়ী Health বা স্বাস্থ্য মানে শুধু রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয় ; স্বাস্থ্য মানে শারীরিক , মানসিক ও সামাজিক দিক থেকে একজন মানুষের কল্যাণ বোধকে বোঝায়। এই তিন দিক থেকেই সুস্থ্য থাকাকে বজায়। এই তিনটি ক্ষেত্রের যেকোনো একটিও ব্যাহত হলেই একজন মানুষ অসুস্থ্য হতে পারেন ।
মানসিক স্বাস্থ্যও এর ব্যাতিক্রম নয়। মানসিক স্বাস্থ্য সামান্য ব্যাহত হলেও মানুষ অসুস্থ্য হতে পারেন। আমরা অনেক সময় বিভিন্ন পরিস্থিতির চাপে পরে সল্প সময়ের জন্যে মানসিক লক্ষণ প্রদর্শন করি , আবার সেই পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে সেই সব লক্ষণ ও চলে যায়। যেমন উদাহরণ সরূপ বলতে পারি - প্রিয়জনের বিয়োগে দুঃখ এবং মানসিক কষ্ট পাওয়া ; পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর সময় পরীক্ষার্থীদের উৎকণ্ঠা ইত্যাদি । এগুলি সব এ সাময়িক এবং কোনোরকম সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার না করেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই এগুলি চলে যায় ।
মানসিক রোগী এবং সুস্থ্য মানুষ এই দুই এর মাঝে কিছু মানুষ থাকেন যাদের মানসিক রোগের প্রবণতা থাকে । এই প্রবণতা গুলি তাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন ভাবেই মিশে থাকে যে এগুলিকে অস্বাভাবিক গণ্য করে এর প্রতিকার করার চেষ্টা করা হয় না। কিছু স্বভাব ,কিছু মানসিকতা , কিছু আচরণ দ্বারা এই গুলি নিজেদের প্রদর্শন করলেও সঠিক সচেতনতার অভাব থাকায় এর কোনো প্রতিকার করা হয় না , উল্টে কিছু ক্ষেত্রে চরম অবহেলা ও ব্যাঙ্গ করা হয়।
এই রকম কিছু মানসিক প্রবণতার কথা আমরা এখন আলোচনা করবো -
1. 28 বছরের অরিত্র। একটি মোবাইলের দোকান আছে তার। রাত্রে দোকান বন্ধ করার সময় 3 টি তালা 2-3 বার টেনে দেখে নেয় ঠিক থাক বন্ধ হয়েছে কি না। ইদানিং সে গুনে গুনে 10 বার 3 টি তালা টেনে দেখে, মাঝপথে গুনতে ভুলে গেলে আবার প্রথম থেকে গোনে । এখন তার তালা গুনতে আধ ঘন্টা লেগে যাচ্ছে , সে হাপিয়ে যাচ্ছে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সে এটা না করে যেতেও পারছে না।
2. তারক বাবুর বয়স 65 বছর । এআস্ত্রী , পুত্র, বৌমা ও নাতি নিয়ে ভরা সংসার। খুব গল্প করতে ভালো বাসেন । ইদানিং সবসময় বিরক্ত হয়ে থাকেন। স্ত্রী এর সাথে বেশি কথা বলেন না , নাতির সাথেও খেলেন না। সিনেমা , TV দেখতে ভালোবাসতেন। এখন এসব করেন না , বেশির ভাগ সময় শুয়ে শুয়ে কাটান আর কারুর সাথে গল্প করেন না। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই বলেন তার ভালো লাগছে না।
3. কল্পনা গোস্বামী, বয়স 68 বছর । সারাদিন তার একটাই কাজ ঘর পোঁছা । বাড়িতে কেউ এলে তাকে ঘরে ডাকতে চান না , কারণ বাইরের কেউ যে ঘরে আসবে বা যা যা ছোঁবে সেগুলো সব তাকে আবার ধুতে হবে। এমন কি কেউ কলিং বেল বাজলেও সেটাও কাপড় জলে ভিজিয়ে পরিষ্কারর করেন ।
4. শুক্লা ঘোষ বয়স 35 বছর । বিয়ে করেননি , টিউশনি করেন। উনি টাকা ধুয়ে তবে সেটা বাড়িতে রাখেন। বাজার করেই হোক আর ব্যাঙ্ক থেকেই হোক যে কোনো টাকা উনি দিয়ে ব্যবহার করেন। ওনার ধারণা টাকা অনেক মানুষের হাতে ঘোরে , তাই জীবাণু থাকবেই এবং শরীর খারাপ করতেই পারে না ধুয়ে ব্যবহার করলে।
5. কমলেশ্বর বাবুর আজ বহু বছর হয়ে গেল অফিস থেকে ফিরে একটাই অভ্যাস , জামা কাপড় থেকে শুরু করে টাকা পয়সা , অফিস এর ব্যাগ ও জলে চুবিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। নাহলে ওনার স্ত্রী ঘরে ঢুকতে দেবেন না। বাজার করে ফেরার পর সব সবজি , মাছ মাংস এমন কি খবরের কাগজও ধুয়ে নিতে হয়। ওনারা প্যাকেট দুধ খান কেননা ওটা ধোয়া যাবে, গোয়ালার দুধ ধোয়া না।
6. একজন মহিলা , গ্রামের দিকে বাড়ি। উনি সারাক্ষন ধূপের গন্ধ পান । সেখানে ধুপ জ্বলছে না অথচ তিনি সারাক্ষন ধূপের গন্ধ পাচ্ছেন এবং ওনার রাগ সীমার বাইরে চলে যায় তখন ওনাকে ধরে বেঁধে রাখা যায় না।
7. মালতী দেবী , বয়স 60 বছর । উনি সবসময় ভাবেন উনি ঠিক বাকি সবাই ভুল । ওনার কেউ ভুল ধরলেই উনি রেগে যান। উনি নিজের অজান্তেই প্রচন্ড মিথ্যে কথা বলেন এবং নিজেকে victim বানিয়ে অন্যের সহানুভূতি প্রত্যাশা করেন। এই সমস্ত আচরণের জন্যে ওনার বাড়ির পরিস্থিতি খুব ই সমস্যাজনক ।
8. অনিক , বয়স 14 বছর। প্রচন্ড মিথ্যে কথা বলে , মারপিট করে। স্কুলে , বাড়িতে এবং আত্মীয়ের বাড়িতে একাধিক বার চুরি করে ধরা পড়েছে। অন্য লোকের ক্ষতি করে যেমন স্কুল এ বা পাড়ায় । বাড়ির লোকেরা অনেক বুঝিয়েছে , মারধর করেছে কিন্তু সে শোধরায়নি।
9. রাজেশ , বয়স 21 বছর , বাবা মারা যাওয়ায় রেল এ চাকরি পেয়েছে । কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবার । কাজে যেতে তার মন নেই , মনে খুশি ,মুখে হাসি নেই। কোনো কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। ঘুম , খিদে একদম কমে গেছে। , সবসময় বিরক্তভাব। তার মনে হয় সে চাকরি ছেড়ে দেবে নাহলে রেল লাইনে আত্মহত্যা করবে।
10. মীরা , বয়স 17 বছর। উচ্চমাধ্যমিক দেবে। ডাক্তার হবার খুব ইচ্ছে । দিন কয়েক হলো সে এক এক পড়তে যেতে ভয় পাচ্ছে , মা কে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির দোতলায় এক থাকলে তার ভয় হচ্ছে , বুক ধড়ফড় করছে , প্রচন্ড ঘেমে যাচ্ছে।
উপরের ঘটনা গুলি আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেকেই দেখেছি । কিন্তু এগুলি কোনো মানসিক রোগের পূর্বাভাস তা আমরা বুঝতে পারিনি। ফল স্বরূপ এই মানুষ গুলির কোনো চিকিৎসা হয়নি এবং তারা এক অসহনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।
উপরের বিবরণ গুলি যে রোগের মধ্যে পড়তে পারে সেটি হলো -
1,3 ,4 এবং 5 নম্বর OCD বা অবসেসসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার
2 নম্বর - অবসাদ বা ডিপ্রেশন
6 নম্বর - হ্যালুসিনেশান ( এটি Schizophrenia বা Mood Disorder এ দেখা যায়)
7 নম্বর - Personality disorder or Mood disorder
8 নম্বর - অপরাধ প্রবণ মানসিকতা ( এটিও একধরণের Personality Disorder)
9 নম্বর - অবসাদ বা ডিপ্রেশন
10 নম্বর - আতঙ্ক বা ফোবিয়া (Phobia) ।
উপরের কেস গুলি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । আমাদের চারপাশে এই রকম আরো অনেক মানসিক রোগের লক্ষণ বা পূর্ব লক্ষণ আমরা দেখতে পাই । কিন্তু আমাদের সচেতনতার অভাবে আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি না । এনারা হয়তো একটু সামান্য সাহায্য পেলে এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে পারেন ।
এই রকম কোনো সমস্যা আপনার আশেপাশে দেখলেই তাকে ডাক্তার বাবুর কাছে নিয়ে যান বা যাবার পরামর্শ দিন এবং ডাক্তার বাবু কে সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বলুন ।
আপনি এই আর্টিকেল টি পরে যদি মনে করেন আপনার এই রকম কোনো সমস্যা আছে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারবাবুর সাথে যোগাযোগ করুন ।
সচেতনতা এবং সহমর্মিতা দিয়ে আমাদের এক মানসিক ভাবে সুস্থ্য সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করুন ।
No comments:
Post a Comment