এই আধুনিক যুগে আমাদের জীবনে এক অপরিহার্য সঙ্গী হলো মোবাইল ফোন । অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্র যেটা ছাড়া আমরা আমাদের জীবন ভাবতেও পারিনা । স্মার্টফোন মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট কানেকশন আজকে চাইই চাই।
এর অনেকগুলি কাজের মধ্যে আরেকটি কাজ নতুন সংযোজন হয়েছে শিশুকে ভুলিয়ে রাখা । 1-2 বছরের বাচ্ছার হাতেও মোবাইল ফোন বা ট্যাব । স্মার্ট ফোনের যুগে শিশুরাও যেমন স্মার্ট তাদের মায়েরাও আরো বেশি স্মার্ট। বাচ্ছা খেতে চাইছে না , খেতে খেতে ঘ্যান ঘ্যান করছে - দাওয়াই হাতের সামনেই আছে - মোবাইল বা ট্যাব । চালিয়ে দাও কার্টুন , শিশুদের গান বা শিশুদের জন্যে তৈরী ভিডিও ক্লিপিংস - ব্যাস কেল্লা ফতে । বাচ্ছা হা করে খাবার খাচ্ছে বটে কিন্তু মন দিয়ে গিলছে ওই মোবাইল নামক বস্তুর থেকে প্রাপ্ত entertainment । যাই হোক বাবা মা খুশি , বাড়ির সবাই খুশি - আমার বাচ্ছা সব খেয়ে নেয়; শুধু মোবাইল এ ভিডিও চালিয়ে দিতে হবে ।
সত্যিই কি খুব খুশির খবর এটা। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু অন্য কথা বলছে । খেতে খেতে মোবাইল দেখার অভ্যাস যথেষ্ট ক্ষতিকারক । প্রাথমিক ভাবে হয়তো শিশু খাবার খেয়ে নিচ্ছে , কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই ।
খেতে খেতে মোবাইল এর অভ্যাস শিশুদের কি কি ক্ষতি করছে এবং এর সম্ভাব্য প্রতিকার :-
1. ছোট শিশুদের কাছে খাবার খাওয়া একটি নতুন অভিজ্ঞতা । নতুন নতুন খাবার এর সাথে শিশুর পরিচয় হওয়া , খাবার স্বাদ গ্রহণ করা এগুলি সব ই শিশু ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে । কিন্তু মোবাইল দেখিয়ে খাওয়ালে শিশুর সমস্ত মনোযোগ থাকে সেই দিকে খাবার এর দিকে নয় । ফলে খাবারের সাথে শিশুর সংযোগ - ঘনিষ্ঠতা - ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যায় । মোবাইল দেখার নেশায় সে যন্ত্রের মতন শুধু খাবার খায় , আত্মস্থ করে না।
2. মোবাইল দেখলে তবে খাবে নাহলে বাচ্ছা খাবার খাবেই না । এর অর্থ সে মোবাইল এর সাথে Conditioning হয়ে গেছে । ফলে যখন মোবাইল দেখানো হবে না সে খেতেই চাইবে না ।
3. মোবাইল এ শিশু যা দেখে তার একটি আসক্তিমূলক উপাদান বা addictive component আছে , যা শিশুকে মোবাইল নির্ভরশীল করে তুলছে ।
4. শিশু বড় হবার সাথে যত বেশি করে বাইরের পরিবেশের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবে ততই তার বিকাশ ভালো হবে । কিন্তু external world এর সাথে যত সম্পর্ক কমবে তার মস্তিস্ক কম বিকশিত হবে এবং শিশুর Physical ও Psychological বৃদ্ধির ও ব্যাঘাত ঘটবে । খেতে খেতে যে মোবাইল এর আসক্তি জন্মাচ্ছে সেটির ফলে শিশুর external connection যেমন খেলাধুলা বন্ধ হলে উপরের সমস্যা গুলিও হতে পারে ।
5. 1-2 বছরের শিশুর মোবাইল দেখিয়ে খাবার অভ্যাস আস্তে আস্তে 4-5 বছরের শিশুর আসক্তিতে পরিণত হবে । মোবাইল এর প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়বে । ফলে শিশুর normal growth & skill এর ব্যাঘাত ঘটবে যেমন - শিশু খেলাধুলা , বই পড়া , বন্ধু তৈরী করা , সামাজিক মেলামেশা ইত্যাদি করতে পারবে না । বয়ঃসন্ধিক্ষণে এই আসক্তি আরো বাড়বে । শিশুর Social Skill একদম নষ্ট হয়ে যাবে ।
একটু বাচ্ছা যখন বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে তখন সে বাইরের পরিবেশের সাথে পরিচিত হয়। অন্য বাচ্ছাদের সাথে খেলা , মেশা , ঝগড়া করা , বন্ধুত্ব করা ইত্যাদির মাধ্যমেই গড়ে ওঠে Social Skill , Problem Solving Ability ইত্যাদি। কিভাবে অন্য মানুষের সাথে সংযোগ করবো , কিভাবে কথা বলবো , কিভাবে ছোট ছোট সমস্যা নিজে বা বন্ধুদের সাথে মিলে সমাধান করবো , কিভাবে Peer group তৈরী করবো ইত্যাদি skill গুলি আমাদের শিখতে হয় এবং এই সব শেখার প্রাথমিক ধাপ শুরু হয় শিশু বয়স থেকেই । তাই Social Skill বা সামাজিক দক্ষতা তখন ই বাড়বে বা তৈরী হবে যখন শিশু ছোট থেকেই বাইরের পরিবেশের সাথে একাত্ম হবে ।
6. মোবাইল এ ভিডিও দেখা বা গেম খেলার সব কিছুতেই Repeat option আছে। অর্থে বারে বারে ওই এক ই কাজ করা যায়। কিন্তু বাস্তব জীবনে এই সুযোগ থাকেনা , বাস্তব জীবনে খেলাধুলাতেও challenges বেশি। তাই শিশুর কাছে মোবাইল অনেক সহজ বোধ হয় খেলাধুলার তুলনায় । এর ফলে শিশুর মানসিক বোধশক্তি সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এবং বাড়তে পারে না ।
7. Failure is the Piller of Life . মোবাইল এর জগতে ফেল হলেও খুব সহজেই আবার পাস করা যায় কিন্তু বাস্তব জীবনে যা খুব সহজ নয় । ফলে বাস্তবে fail হলে শিশু সেটা কাটিয়ে উঠতে পারে না ।
8. বহির্জগতের প্রতি যত সম্পর্ক কমবে শিশুর সামাজিক বৃদ্ধি , Emotional Intelligence ততই কমবে ।
9. খাবার খাওয়াই বাচ্ছার কাছে একটি entertainment বা আনন্দের কাজ । এটাকে সে উপভোগ করতে করতেই শিখতে পারে । প্রতিটি খাবার এর স্বাদ , তার রং , গন্ধ , মুখে দিলে কেমন লাগছে - এগুলি শিশু ধীরে ধীরে আত্মস্থ করে । এই আত্মস্থ করার মধ্যেও শেখার আনন্দ থাকে । এইভাবে প্রতিটি খাবার এর সাথে শিশুর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে । কিন্তু মোবাইল দেখতে দেখতে খেলে তার মনোযোগ পুরো পুরি খাবার থেকে সরে যায় । তাই খাবার এর সাথে আর শিশুর সম্পর্ক আর গড়ে ওঠে না ।
10. মোবাইল দেখেই হোক বাচ্ছা তো খাচ্ছে । তাই পুষ্টি তো পাচ্ছে । কিন্তু একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে সব কিছুই আমাদের মনের সাথে সম্পর্ক যুক্ত । তাই মোবাইল দেখে খাওয়ার একটি নেতিবাচক মানসিক প্রভাব থাকবেই যা শিশুর পুষ্টিতে প্রভাব ফেলতে বাধ্য ।
শিশু সব কিছুই শেখে তার জন্মের পর । আমরা তাকে যা শেখাবো , সেটাই সে শিখবে । তাই আমরা তাকে কিভাবে শেখাচ্ছি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোবাইল আসার আগেও শিশুরা খেতে চাইতো না এবং ঘ্যান ঘ্যান করতো ; তখন ও বাবা মা এরা শিশুকে কবিতা বলে , গান শুনিয়ে , বাগান এ ঘুরিয়ে , ফুল দেখতে দেখতে নানান ভাবে ভুলিয়ে খাওয়াতো ; যার কোনো সুদূরপ্রসারী খারাপ প্রভাব থাকতো না । মোবাইল ব্যবহার না করে দেখুন না অন্য কোনো পন্থা ব্যবহার করে যা শিশুর মানসিক বিকাশে সাহায্য করবে।